দিনাজপুরের যে বাজারে প্রতিদিন দেড় থেকে দুই কোটি টাকার টমেটো বিক্রি হয়

নিউজ ডেস্ক | /DAILYNABARAJ24.COM

প্রতিবেদন প্রকাশ: ১৭ এপ্রিল ২০২৫, সময়ঃ ১২:০৮


ভোরের আলো ফোটার আগেই শুরু হয় দিনাজপুরের টমেটোর বাজারটি। প্রায় দেড় কিলোমিটার সড়কের উভয় পাশে ভ্যানগাড়ি, ট্রাক, মোটরসাইকেল, পিকআপ ভ্যান আর মানুষে মানুষে ঠাসাঠাসি থাকে বাজার এলাকা। খানিকটা দূর থেকেই কানে আসে যানবাহনের হর্ন আর দরদামের হাঁকডাক। সকাল ৯টার মধ্যে দর–কষাকষি ও কেনাবেচা শেষ। এরপর বিকেল পর্যন্ত চলে লোড-আনলোড। ট্রাকে করে টমেটো যায় ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট, নারায়গঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। দৈনিক গড়ে দেড় থেকে দুই কোটি টাকার টমেটো কেনাবেচা হয় দিনাজপুরের গাবুড়া বাজারে।

স্থানীয় লোকজন বলছেন, খুব বেশি আগের কথা নয়। নব্বইয়ের দশকে সদর উপজেলার গর্ভেশ্বরী নদীর তীরে গাবুড়া এলাকায় টমেটোর বাজারটি শুরু হয়। এর মধ্যে দেশের প্রায় সব জেলার সবজি ব্যবসায়ী, বিশেষ করে টমেটো ব্যবসায়ীর কাছে পরিচিতি পেয়েছে বাজারটি। প্রতিবছর মার্চ মাসের মাঝামাঝি থেকে শুরু হয়ে চলে জুনের শেষ পর্যন্ত। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ২৫০ থেকে ৩০০ জন পাইকার আসেন টমেটো কিনতে। মৌসুমের পুরো সময় তাঁরা দিনাজপুরেই থেকে যান। এই সময়ে অন্তত ৮ থেকে ১০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হয় এখানে। যাদের মধ্যে বড় একটা অংশ স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী।

গত মঙ্গলবার বাজার ঘুরে দেখা যায়, রাস্তার দুই পাশে সারি সারি দাঁড়ানো ভ্যানগাড়ি। প্রতি গাড়িতে দুই থেকে চারটি বড় আকারের ঝুড়িতে ভর্তি টমেটো। নামেও রয়েছে ভিন্নতা। বিপুল প্লাস, প্রভেনসিভ, রোমা ভিএফ, মিন্টু সুপার, আনসাল, রানী ও শক্তি প্লাস। কোনোটি গোলাকার, কোনোটি লম্বাকৃতির। নেড়েচেড়ে দেখছেন পাইকার। দামে মিললে নেওয়া হচ্ছে সংশ্লিষ্ট পাইকারের আড়তঘরে। সেখানে ক্যারেটে (প্লাস্টিকের ঝুড়ি) ভরানো হচ্ছে। পাশেই দাঁড় করানো ট্রাকে ক্যারেটগুলো তুলছেন ট্রাকশ্রমিকেরা।

ট্রাকশ্রমিক মনসুর আলী বলেন, প্রতি ট্রাকে ৫৬০ ক্যারেট পর্যন্ত মাল লোড করেন তাঁরা। ক্যারেটপ্রতি পান ৪ টাকা। এক ক্যারেটে টমেটো থাকে ২৫ থেকে ২৬ কেজি। হিসাব অনুযায়ী, ওই পরিমাণ ক্যারেটে টমেটো থাকে প্রায় ১৪ হাজার কেজি বা ৩৫০ মণ। এই বাজার থেকে মৌসুমে গড়ে দৈনিক ৯০ থেকে ১০০টি ট্রাকে দেশের বিভিন্ন জেলায় টমেটো যায়। যার পরিমাণ দাঁড়ায় দৈনিক সাড়ে ৩১ হাজার মণ। মঙ্গলবার বাজারে জাত ও মানভেদে প্রতি মণ টমেটো বিক্রি হয়েছে ৫০০ থেকে ৫৪০ টাকা পর্যন্ত। আর ট্রাক লোড হয়েছে ৯১টি। সেই হিসাবে মঙ্গলবার প্রায় দেড় কোটি টাকার টমেটো কেনাবেচা হয়েছে গাবুড়া বাজারে।

স্থানীয় কয়েকজন চাষির সঙ্গে আলাপে জানা গেল, ১৯৯০–১৯৯১ সালের কথা। সদর উপজেলার রাজারামপুর, কৃষাণ বাজার এবং চিরিরবন্দর উপজেলার অনেক কৃষকই তরমুজ আবাদ করতেন। ভালো ফলন পেয়ে লাভের মুখও দেখছিলেন তাঁরা। সেই তরমুজ আবদুল বাতেন (বর্তমানে দক্ষিণ আফ্রিকাপ্রবাসী) নামের স্থানীয় এক ব্যবসায়ী নারায়ণগঞ্জের এক ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রির জন্য ট্রাকে করে পাঠাতেন। একবার শিলাবৃষ্টিতে নষ্ট হয় তরমুজের আবাদ। একই সময়ে এলাকায় খলিলুর রহমান, দামুদার রায়, কামরুজ্জামানসহ কয়েকজন কৃষক অল্প পরিমাণ টমেটোর আবাদ করতেন। স্থানীয় বাজারেই এগুলো বিক্রি হতো। বাতেন নারায়ণগঞ্জের ব্যবসায়ী বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করে শুরু করেন টমেটোর ব্যবসা। চাহিদা ও লাভ দেখে তরমুজ ছেড়ে স্থানীয় কৃষকেরা টমেটোর আবাদে মন দেন। নারায়ণগঞ্জের সেই ব্যবসায়ী বন্ধু টমেটো কিনতে এলেন দিনাজপুরে। ছড়িয়ে পড়ল গাবুড়া টমেটো বাজারের নাম.

টমেটো ব্যবসায়ী ইমতিয়াজ হোসেন (৪০) বলেন, হাতে গোনা পাঁচ-ছয়টি ছোট দোকান ছিল এই এলাকায়। পাশেই লাগোয়া গোপালপুর হাট (ছোট বাজার)। সেখানে এখন বড় বড় দালান উঠেছে। রাজারামপুর, গাবুড়া, মস্তানবাজার মিলে কমপক্ষে সাড়ে চার শ দোকান হয়েছে। আগে যে পাইকাররা সারা দিন টমেটো কিনে শহরে গিয়ে থাকতেন, এখন এখানেই ঘর ভাড়া নিয়ে থাকছেন। মৌসুমে একেকটি কক্ষের ভাড়া হয়েছে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। বাইরে থেকে আসা ব্যাপারীদের পাশাপাশি স্থানীয়ভাবেও অনেকে এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়ে আর্থিক সচ্ছলতা এনেছেন।

টমেটো চাষ করে দিনাজপুর, চিরিরবন্দর ও বীরগঞ্জ এলাকার অনেক কৃষকই সফল হয়েছেন। যাঁরা একসময় বর্গা নিয়ে চাষ করতেন, গত কয়েক বছরে তিনি কয়েক বিঘা জমির মালিক হয়েছেন। পাকা বাড়ি তুলেছেন, গরুর খামারও করেছেন। টমেটো চাষি আবদুর রশিদ বলেন, ‘প্রতিবার যে লাভ হয়, এমনটাও নয়। তবে যেবার ভালো দাম যায়, সেবার বিঘায় কেউ কেউ এক লাখ টাকাও লাভ পায়। বিক্রির সময় মণপ্রতি ১৫ টাকা খাজনা যায়, আবার প্রতি মণে পাইকারকে তিন কেজি ধলতা (অতিরিক্ত) দিতে হয়। এটা কমানো উচিত। এই ফসল ফলাতে বর্তমান বাজারে প্রতি বিঘায় খরচ পড়ছে ৭০ থেকে ৭৫ হাজার টাকা। তার ওপর দাম নিয়ে তো দুশ্চিন্তা থাকেই।’

এই বাজারে ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে শরীয়তপুর থেকে টমেটো কিনতে আসেন চান মিয়া খালাসী (৫২)। তিনি বলেন, এবার ঈদের দুই দিন পরেই এসেছেন। দৈনিক পাঁচ থেকে সাতটি ট্রাক লোড করা হচ্ছে। এখানকার টমেটোর একটা সুনাম আছে। চাষিদের সঙ্গে একটা ভালো সম্পর্ক আছে তাঁদের। এমন অনেক ব্যবসায়ীই আছেন, যাঁরা চাষিদের উৎপাদন খরচ আগেই দিয়ে রাখেন। ফল পাকলে চাষিই খবর দেন ওই ব্যবসায়ীকে। বর্তমানে এই বাজারে শুধু দিনাজপুরের ১৩টি উপজেলা থেকেই নয়, ঠাকুরগাঁও থেকেও টমেটো আসে।

এ বিষয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (শস্য) আনিছুজ্জামান বলেন, ‘এখনকার কৃষক অনেক স্মার্ট। টমেটো খুবই স্পর্শকাতর ফসল। তবে লাভজনক হওয়ায় এর প্রতি কৃষকের অধিক গুরুত্ব থাকে। কৃষি বিভাগ ইতিমধ্যে নতুন কিছু জাতের সঙ্গে কৃষকদের পরিচয় করিয়েছে। সবশেষ হাজী দানেশ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক “শক্তি প্লাস” নামের অধিক ফলনশীল একটি জাতও উদ্ভাবন করেছেন। গত অর্থবছরে যেখানে টমেটোর আবাদ হয়েছিল ৯২৫ হেক্টর জমিতে, এবার সেখানে ১ হাজার ৫৭৮ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি আবাদ হয় চিরিরবন্দর ও সদর উপজেলায়। আশার কথা হচ্ছে, ইতিমধ্যে কৃষি বিপণন বিভাগ থেকে গাবুড়া এলাকায় টমেটোসহ অন্যান্য কৃষিপণ্য সংরক্ষণের জন্য একটি হিমাগার নির্মাণ করা হচ্ছে। খুব শিগগিরই এটি উদ্বোধন করা হবে।’

 


সম্পাদক ও প্রকাশকঃ ইফতেখার আহমেদ টিপু

ফোন ও ই-মেইল +8801718463345 mofo.nabaraj@gmail.com dailynabaraj24@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বানিজ্যিক কার্যালয়

১২ বিপনন বা/এ, সোনারতরী টাওয়ার, বাংলামটর, শাহবাগ, ঢাকা, বাংলাদেশ।

© dinajpurnews24.com ২০২৫ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।